POPULATION POLICY
জনসংখ্যা নীতি হল জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ এর উদ্দেশ্যে কোণও দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদক্ষেপ সমূহ, যা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্ম-মৃত্যু, বীবাহ, শিশু প্রতিপালন, কর্মের পরিবেশ রচনা, বাসস্থানের স্থান নির্বাচন ইত্যাদি কে নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রতিটি দেশ তাদের জনসংখ্যার পরিমান, জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ও জনসংখ্যার কাঠামো, অর্থনৈতিক প্রগতির স্তর, ইত্যাদির উপরে নির্ভর করে জনসংখ্যা নীতি অনুসরণ করে এবং জনসংখ্যার গঠন কে ভারসাম্যে আনার চেষ্টা করে।
TYPES OF POPULATION POLICY:
জনসংখ্যা নীতি সমূহ যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অনুসরণ করে সেগুলিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়।
Pro- Natalist Policy:
যখন কোন দেশ জন্মহার বৃদ্ধি কে উৎসাহিত করে ও জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার কে বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে তখন সে ধরনের জনসংখ্যা নীতি কে Pro- Natalist Policy বলে।
এক্ষেত্রে জনসংখ্যা নীতি অপ্রত্যক্ষভাবে অনুসরণ করা হয়। কারণ সরকার কোন পরিবার বা ব্যক্তিকে সন্তান গ্রহণে বাধ্য করতে পারে না। তাই সরকার যে সমস্ত ব্যক্তি বা পরিবার সন্তান গ্রহণ করে তাদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। যেমন আর্থিক সাহায্য, নিখরচায় শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, সন্তানের বাবা মার মাতৃত্বকালীন পিতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া, গর্ভপাত প্রতিরোধ আইন বা জনসচেতনতা তৈরি করা, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে নারী তাহার কাজ ও সন্তান প্রতিপালন একইসঙ্গে করতে পারে ইত্যাদি।
সাধারণত জনসংখ্যার স্বল্পতা রয়েছে এমন দেশ গুলি এবং যে সমস্ত দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে সেই সমস্ত দেশে বিবাহ, পরিবার গঠন ও সন্তান উৎপাদনে মানুষের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যার বয়স কাঠামোতে বয়স্ক জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়তে থাকে ও ভবিষ্যৎ কর্মী জনসংখ্যার সম্ভাবনা হ্রাস পেতে থাকে। এরকম অবস্থায় সরকার এই ধরনের নীতি অনুসরণ করে।
দেশ সমূহ: সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ইত্যাদি।
Anti natalist Policy: - Pro natalist জনসংখ্যা নীতির ঠিক বিপরীত নীতি হলো এই Anti natalist policy. যখন কোন দেশ জন্মহার কে নিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির গতিকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন সে ধরনের জনসংখ্যা নীতি কে বলে Anti natalist policy.
সাধারণত যে সমস্ত দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অধিক, জন্মহার অত্যধিক এবং জনবহুলতা ও জনবিস্ফোরণ ঘটে গেছে, শিশু-কিশোর জনসংখ্যা সহ নির্ভরতার হার অনেক বেশি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত, অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ যার ফলে মাথাপিছু আয় ও সম্পদের পরিমাণ সীমিত সেই সমস্ত দেশে এই ধরনের জনসংখ্যা নীতি গ্রহণ করা হয়।
এ ধরনের জনসংখ্যা নীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে।
প্রত্যক্ষ জনসংখ্যা নীতিতে সরকার আইন তৈরি করে ব্যক্তি ও পরিবারকে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করে। যার ফলে জন্মহার সীমিত হয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে আসে।
অপ্রত্যক্ষ জনসংখ্যা নীতিতে সরকার সাধারণত নারী শিক্ষা বৃদ্ধি, নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্য উন্নতি, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা, বহুবিবাহ প্রতিরোধ করা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা, বিবাহের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া, ছোট পরিবার সুখী পরিবার এই সচেতনতার মানুষের মধ্যে প্রচার করা, ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
দেশ সমুহ:
প্রত্যক্ষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ: উদাহরণ হিসেবে চীনের কথা বলা যেতে পারে যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে, one child policy নীতি অনুসরণ করে ১৯৮০ সালে। একটি সন্তানের পরিবার কে নানা রকম সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়। যেমন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভালো পরিবেশে বাড়ি তৈরীর সুযোগ, শিশুর উন্নত শিক্ষার সুযোগ, বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য প্রদান। এছাড়া যে সমস্ত পরিবার এই নীতি অনুসরণ করবে না তাদের জন্য শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন, ফাইন এর ব্যবস্থা, কাজ কেড়ে নেওয়া, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, কোন মহিলা যদি দ্বিতীয় সন্তান ধারণ করেছে ধরা পড়ে তবে তাকে বাধ্যতামূলক গর্ভপাত করিয়ে দেওয়া।
ইন্দিরা গান্ধীর সময় একবারই ভারত সরকার প্রত্যক্ষ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। সেই সময় বাধ্যতামূলক নির্বীজকরণ করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল।
একইসঙ্গে অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি হিসাবে চীন সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যাপক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং দেরিতে বিবাহ করার জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত করে।
অপ্রত্যক্ষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ: উদাহরণ হিসেবে ভারতের জনসংখ্যা নীতির কথা বলা যেতে পারে। ভারতবর্ষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মোটামুটি ১৯২১ সাল থেকেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পরপর সেই বৃদ্ধির হার আরো বেড়ে যায়। সেইজন্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকেই সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ও সেজন্য জন্মহার কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানা ধরনের অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে।
POPULATION POLICY OF INDIA
ভারত একটি অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে অগ্রসরমাণ দেশ, যার জনসংখ্যা বরাবরই দেশের অর্থনৈতিক সম্পদের তুলনায় বেশি ছিল। 1947 এর আগে ভারত ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ছিল। যার ফলে ভারতবর্ষের অধিক জনসংখ্যা ও তার তাৎক্ষণিক এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে ভাবনাচিন্তা বিশেষ এগোয়নি। ফলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অধিক জন্মহার এ আক্রান্ত ও পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র, অসচেতন জনসংখ্যা ছিল ভারতবর্ষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নানারকম মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি লেগেই থাকত এবং সেকারণে মৃত্যুহারও তখন বেশি ছিল।
Post-independence Population policy:
ভারতবর্ষের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও নীতি অনুসরণ শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকে, একেবারে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার হাত ধরে। ভারতবর্ষের এই দীর্ঘ 70 বছরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি বিচার করলে একে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।
1947-51 (period of neutrality)
1951-1961 (period of experimentation)
1961-2000 (beginning of policy of control)
2000 onwards (population policy as national goal)
প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-১৯৬১): Family planning Programme-1 (clinical approach)
ভারতবর্ষে যে সময় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হয় তখন ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা 36 কোটি পার করেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এটা উপলব্ধি করা হয় যে এই বিপুল জনসংখ্যা ইতিমধ্যে ভারতের সীমিত অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে যদিও এই জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন এবং তার জন্য দরকার অতিরিক্ত জন্মহার কে নিয়ন্ত্রন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে "there is no doubt that given a situation in which shortage of capital equipment rather than of labour is the main limiting factor in development, and rapidly growing population is apt to become more a source of embarrassment then off help to a program for raising standard of living".
তাই জন্মহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গৃহীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে।
উদ্দেশ্য:
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা “পরিবার সীমিতকরণ পরিকল্পনা” (Small family planning) হিসেবে পরিগণিত হয়। এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল-
জনসংখ্যার দ্রুতগতির বৃদ্ধির সঠিক কারণ গুলি অনুসন্ধান করা।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি আবিষ্কার ও সেই পদ্ধতি প্রয়োগে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ,
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা,
সরকারি হাসপাতাল, সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় পরিবার পরিকল্পনা কে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তৈরি ঘোষণা করা।
Achievements and challenges:
যদিও এসময় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খুব সামান্যই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। ভারতবর্ষের অধিক জন্মহারের কারণ অনুসন্ধান এবং অল্প কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই হয়নি এই সময়ে।
147 টি ক্লিনিক খোলা হয়েছিল এবং 205 টি ক্লিনিক কে অনুদান প্রদান করা হয়েছিল যাতে করে তারা নিজ নিজ এলাকায় মানুষের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বোঝাতে পারে।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য গুলোকেই বহাল রাখা হয়, তবে এই সময় পরিবার পরিকল্পনা কে দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হিসেবে স্বীকার করা হয়।
উদ্দেশ্য:
এই পরিকল্পনাকালে যে সমস্ত অতিরিক্ত উদ্দেশ্যগুলি গৃহীত হয়েছিল তা হল,
গণমাধ্যমের ব্যবহার করে সচেতনতা প্রচার করা,
স্বেচ্ছা নির্বীর্যকরণ প্রক্রিয়া (Self Sterilisation) চালু করা হয়। প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল পরিষেবা প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও সংস্থা তৈরি করা।
সরকারিও অন্যান্য ক্লিনিকে কর্মরত কর্মীদের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা,
প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা, ও
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণাকে উৎসাহিত করা।
Achievements and challenges:
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালীন যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি গৃহীত হয়েছিল তাকে সফল করতে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এর সঙ্গে রাজ্যস্তরে পরিবার পরিকল্পনা অফিসার পদ তৈরি করা হয় ও কেন্দ্রে পরিবার পরিকল্পনা নির্দেশক (Family Planning Directorate) তৈরি করা হয়।
বরাদ্দকৃত 5 কোটি টাকার মধ্যে মাত্র দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছিল ওই সামান্য বরাদ্দকৃত অর্থের 50% কম। গ্রামীণ এলাকায় 2000 এবং শহরে 500 টি পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু বাস্তবে গ্রামে 1079 টি এবং শহরে 423 টি ক্লিনিক স্থাপন করা সম্ভব হয়। তাই প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কে ভারতের পরিবার পরিকল্পনার ইতিহাসে ক্লিনিক্যাল অ্যাপ্রচ নামে পরিচিত।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬১-৬৬) ও পরবর্তী বার্ষিক পরিকল্পনা কাল (১৯৬৬-৬৯):
উদ্দেশ্য:
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তে যে সমস্ত পরিকল্পনা গৃহীত হয় সেগুলি হল-
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে শিক্ষাদান ও উৎসাহ প্রদান,
পরিবার পরিকল্পনায় উৎসাহী পরিবারকে প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান,
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করা, কর্মীদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা,
প্রয়োজনীয় গবেষণাতে উৎসাহ প্রদান ও অনুদান প্রদান।
বার্ষিক পরিকল্পনাকালে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রনকে গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। ফলে পরিবার পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয় যথেষ্ট পরিমাণে।
Achievements and challenges:
এই সময় পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রামে 1963 টি শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সমষ্টি উন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়নের মতো একেও প্রশাসনিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। ফলে নির্বীর্যকরণ পুরুষের সংখ্যা 13 লক্ষ ছাড়িয়ে যায় যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সেটি ছিল নগণ্য।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬৯-৭৪): Family planning Programme-2
উদ্দেশ্য:
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে পরিবার পরিকল্পনা কে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লক্ষ্য স্থির করা হয়। 1979 এর মধ্যে জন্মহার 3.9 শতাংশ থেকে 2.3 শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়। এজন্য যে সমস্ত পরিকল্পনাগুলি গৃহীত হয় তা হল-
ছোট পরিবার সুখী পরিবার- এই কথাটিকে সমাজে জনপ্রিয় করা,
পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মানুষকে আরো বেশি শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহজলভ্য করা,
এই পরিকল্পনা কালে শিশু ও নারী সহ জনসাস্থ্য পরিষেবায় জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়টিকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে দেওয়া হয়।
এই পরিকল্পনাকালে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো 'Post-Partum scheme' যা যথেষ্ট সাড়া প্রদান কারী সাফল্য এনে দেয়। 1972 সালে মেডিকেল টার্মিনেশন অফ প্রেগনেন্সি আইন চালু হয়।
Achievements and challenges:
এই পরিকল্পনাকালে মোট 286 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় এবং “কম্পালসারি স্টেরিলাইজেশন প্রোগ্রামের” মাধ্যমে 90 লক্ষ যুগলকে নির্ধারণ করা হয় এবং আরো 60 লক্ষ যুগলকে পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়। যদিও এবারও ধার্যকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে অসমর্থ হয়। এর কারণ হিসেবে যে গুলি চিহ্নিত করা হয় তা হলো,
পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব এবং
যথেষ্ট পরিমাণে নির্বীজকরণ ও পরিবার পরিকল্পনা র জন্য খুব প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহের ঘাটতি।
পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৪-৭৯): Family planning Programme-3
উদ্দেশ্য:
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলিকেই পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে গৃহীত হয়। 1984 সালের মধ্যে জন্মহার প্রতি হাজারে 30 থেকে প্রতি হাজারে 25 এ নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়।
Achievements and challenges:
কম্পালসারি স্টেরিলাইজেশন প্রোগ্রামের আওতায় 8.8 মিলিয়ান দম্পতির নির্বীজকরণ করা হয়। পাঁচ বছরের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ নাগালের মধ্যে আনার জন্য নির্বীজকরণ প্রক্রিয়া 33 শতাংশে পৌঁছানোর ধার্য করা হয়।
পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তেই পপুলেশন পলিসি তে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যেখানে স্বাস্থ্য, মাতৃত্ব, ও শিশু স্বাস্থ্য তথা শিশুর অপুষ্টির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
1976 জাতীয় জনসংখ্যা নীতি তে কতগুলি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় জন্ম হার নাগালের মধ্যে রাখার জন্য। যদিও এই পলিসির প্রয়োগে পরিবার পরিকল্পনায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। জোর করে নির্বীর্য করণপদ্ধতি মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে ও সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এরই প্রত্যক্ষ প্রভাবে 1977 ধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতন হয়।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫): Family planning Programme
উদ্দেশ্য:
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ববর্তী পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে রিভিউ করা হয় এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করা হয়। যেমন বাধ্যতামূলক নির্বীজকরণ পরিত্যাগ করা হয়। পরিবর্তে স্বেচ্ছা নির্বীজকরণ টার্গেট বাড়িয়ে ধরে জনগণকে সচেতন করার দিকে নজর দেয়া হয়। সঙ্গে অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়।
Achievements and challenges:
জন্মনিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা ও কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মিশ্র প্রভাব আনে। সাফল্যের মধ্যে জনমানুষের মনে যথেষ্ট সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, জন্মহার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে, প্রশাসনিক কাঠামো মজবুত হয় ইত্যাদি।
নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে খুব সামান্যই জন্মহার ও জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যেগুলির উল্লেখ করা হয় তা হল, সুনির্দিষ্ট ও উপযোগী পদ্ধতির অভাব, সাধারণ মানুষের অসহযোগিতা, সামাজিক বাধা, ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধিতা, যথেষ্ট প্রচার এর অভাব, দক্ষ কর্মচারীর অভাব এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত অর্থের অভাব। ফলে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
National population policy, 2000
এটা অনুমান করা গিয়েছিল যে বিংশ শতকের শেষে ভারতের জনসংখ্যা বিলিয়ন মার্ক (১০০ কোটি) পেরিয়ে যাবে। তাই 2000 সালে একটি জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়, যেটি এখনো পর্যন্ত একটি সামগ্রিক ও সর্বাত্তক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি ধরা হয়।
জনসংখ্যার বর্তমান বার্ষিক বৃদ্ধি দেশের সম্পদের সঙ্গে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সম্পদ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ঘোষণা হয় 2000 সালের 15 ফেব্রুয়ারি।
উদ্দেশ্য:
জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে মোট 14 টি জনসংখ্যাগত লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল এবং 12 টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধারণ করা হয়। এই নীতির উদ্দেশ্যর তিনটি দিক ছিল।
তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য:
তাৎক্ষণিকভাবে যে উদ্দেশ্য ধার্য করা হয় সেগুলি হল, গর্ভ নিরোধক উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা। এই সমস্ত পরিষেবাগুলি প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
মধ্যমেয়াদি উদ্দেশ্য:
এক্ষেত্রে আন্ত-ক্ষেত্রীয় কার্যনির্বাহী কৌশলগুলোকে (Inter-Sectoral Operational Strategies) আরও জোরালোভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে 2010 সালের মধ্যে সার্বিক প্রজনন হার (TFR) replacement level র মধ্যে আনতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য:
দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যে শক্তিশালী দেশের অর্থনীতি, সামাজিক সুরক্ষা ও বিকাশ, পরিবেশ সুরক্ষা ইত্যাদি প্রয়োজন গুলোকে আরো সুসংহত করার দিকে নজর দেওয়া হয়।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে 2045 সালের মধ্যে স্থিতিশীল অবস্থায় (stable population) আনার পরিকল্পনা করা হয়। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে 30 এর নিচে নামানোর পরিকল্পনা করা হয়।
National socio-demographic goals for 2010:
নিচে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি 2000 সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা গুলি বর্ণনা করা হলো।
2045 সালের মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির স্থিতাবস্থা অর্জন,
প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর 30 এর নিচে নামানো,
প্রতি 1 লাখ জন্মে শিশুমৃত্যু 100 র নিচে নামানো।
14 বছর পর্যন্ত স্কুল শিক্ষা ফ্রী করা ও মাধ্যমিক স্তর এ 20% এর নিচে পর্যন্ত ড্রপ-আউট নামানো।
শিশুর সার্বিক টিকাকরণ সফল করা।
নারী শিক্ষার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে দেরিতে বিয়ে কে জনপ্রিয় করা। এই মর্মে বিয়ের বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে 18 এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে 20 করা হয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা সরকারি হাসপাতাল তথা সর্বোপরী দক্ষ কর্মীর হাতে জন্মদান নিশ্চিত করা ৮০ শতাংশের উপরে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, ইত্যাদি বিষয়ক তথ্যের সহজলভ্যতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষ কে বোঝানো ও পরামর্শ প্রদান নিশ্চিত করা।
জন্ম ও মৃত্যুর তথা বিবাহ ও প্রেগনেন্সির 100% রেজিস্ট্রেশন সুনিশ্চিত করা।
AIDS সহ অন্যান্য সংক্রামক যৌন রোগ প্রতিরোধ করা।
ছোট পরিবারের ধারণাকে সর্বাত্মকভাবে জনপ্রিয় করা যাতে করে সার্বিক প্রজনন হার (TFR) 2.1 এর নিচে নেমে যায়।
Strategic themes (কৌশলগত বিষয়)
জাতীয় জনসংখ্যা নীতি 2000 এ মোট 12 টি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা হয়।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পরিকল্পনা বিকেন্দ্রীভূত করার কথা বলা হয়।
প্রত্যন্ত গ্রামে স্বাস্থ্যপরিসেবা ও পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করা,
উন্নত স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন,
শিশুর সুস্বাস্থ্য ও জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত,
পরিবার কল্যাণে না পূরণ হওয়া লক্ষ্যগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা,
সরকারিভাবে পরিষেবার আওতার বাইরে থাকা এলাকা ও গোষ্ঠী গুলোর প্রতি নজর দেওয়া: যেমন বস্তি, আদিবাসী এলাকা, পাহাড়ি এলাকা, উদ্বাস্তু এলাকা ইত্যাদি। পুরুষ সদস্য কে সক্রিয় পিতৃত্বের দায়িত্ব বোঝানো।
ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ,
প্রাইভেট ও এনজিও এর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করা,
হোমিওপ্যাথি ও অন্যান্য ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করা,
প্রজনন, শিশু জন্ম, জন্মনিয়ন্ত্রন প্রযুক্তি ও তার গবেষণাকে জনপ্রিয় করা,
বয়স্ক জনগণের প্রতি নজর দেওয়া,
সর্বোপরি তথ্য সরবরাহ বৃদ্ধি, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো।
Achievements and challenges:
জাতীয় জনসংখ্যা নীতি 2000 একটি সর্বাত্মক পরিকল্পনা ছিল যদিও তার সাফল্য সীমিত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি বহু ক্ষেত্রীয় পদ্ধতি হওয়া বাঞ্ছনীয় যেখানে নিরন্তর প্রচেষ্টা ও দেখাশোনা দরকার। শিক্ষার প্রসার, দারিদ্র দূরীকরণ, মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আরও সক্রিয় স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন উপলব্ধি করা হয়।
No comments:
Post a Comment