এইতো কিছুদিন আগেও আমরা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি- লকডাউন! দীর্ঘ দিন আমি আপনি সেই লকডাউন এ এক প্রকার গৃহবন্দী ছিলাম! করনাসুর (COVID 19) এসেছিল, দেবতাকুল (পড়ুন ডাক্তার) প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছেন তাকে বধ করতে। মানুষ ছিল আক্রান্ত, শঙ্কিত, পরিবারের সবাই মিলে ঘরে বসে দিনাতিপাত করেছে! কমবেশি সবাই মৃত্যু ভয়ে কিছুদিন হলেও শঙ্কিত থেকেছেন। যতদিন ভ্যাকসিন আসেনি, আমরা সবাই confused ছিলাম কিভাবে করোনা আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করবো! যদিও তার মধ্যেও বিরাট সংখ্যক অসচেতন ভারতীয় করোনা বিধিনিষেধ না মেনে থেকেছেন, কেউ কেউ করোনা মহামারী কে অস্বীকারও করেছেন। তবে যাই হোক, দীর্ঘ লকডাউন এ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সমাজের প্রায় সব পেশার মানুষ (ব্যতিক্রম- সরকারি চাকরিজীবী)! দেশের ক্ষুদ্র থেকে মাঝারী থেকে বৃহৎ শিল্প ও ব্যবসা তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। তার পর ভ্যাকসিন এলো, নানা বিতর্কের পর অবশেষে সরকার সকলকে ফ্রী তে ভ্যাকসিন দিলেন, প্রাই সবাই নিল। অনেককে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভ্যাকসিন নিতে হয়েছিল।
এখন আর সেকথা বিশ্বাস ই হয়না! আবার সব কিছু স্বাভাবিক! শিল্প বাণিজ্য গম গম করে চলছে, নতুন প্রযুক্তি যা লকডাউন আমাদের দিয়েছে আমরা সেটা সঙ্গে নিয়েই আমরা নতুন স্বাভাবিকতা র পথে এখন চলেছি। কিন্তু আমরা কি বুঝলাম এই বিশ্বব্যাপী মহামারী থেকে? আমি পরিবেশ এর দৃষ্টি কোন থেকে বলবো:
আসুন, একটু ঘুরে আসি রাচেল কারসন এর কাছ থেকে।
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য বহু আলোচনা, সম্মেলন হয়েছে, প্রতিবছর পালিত হয়েছে পরিবেশ এর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দিবস উদযাপন। তবুও আমরা উত্তরোত্তর পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার বৃদ্ধিই দেখেছি। মাটি, জল, বাতাস নৈসর্গিক পরিবেশ ক্রমশ হয়েছে অবিশুদ্ধ, ও ব্যবহার অযোগ্য।
বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা প্রসারে খরচ করা হয়েছে কোটি থেকে লক্ষ বিলিয়ন ডলার। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কিশোরী ছাত্রীর ডাকে জলবায়ু ধর্মঘট ও দেখে নিয়েছি আমরা।
তবু অধিকাংশ মানুষের মধ্যে নূন্যতম পরিবেশ সচেতনতা বা পরিবেশের প্রতি স্বহৃদয় মনোভাব বা প্রতিবেশী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি ‘ইকো‘ মনোভাব তৈরি হয়নি।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের ইগো কাজ করেছে, সে হয়ে উঠেছে চরম ভোগবাদী, স্বেচ্ছাচারী। যথেচ্ছাচার করেছে পরিবেশের উপর, পরিবেশের অন্যান্য জীবের বেঁচে থাকার ওপরে হেনেছে আঘাত। তৈরি করেছে মাটির উপর কংক্রিটের চাদর, সবুজ উদ্ভিদের জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল, মাটি থেকে আকাশ ছুতে চেয়েছে সুউচ্চ ইমারত, নদীকে বেধেছে, বিশাল অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের সলিল সমাধি দিয়ে, জঙ্গলকে টুকরো টুকরো করেছে অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থানকে কেড়ে নিয়ে, মাটিতে কীটনাশক দিয়ে কেড়েছে কোটি ক্ষুদ্র জীবের প্রাণ, না জানি কত ভূমি ও জলাশয় মৃত ভূমিতে পরিণত হয়েছে এতদিনে।
শিল্পের মালিক শিল্পের উৎপাদন ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে চলেছে দূষিত তরল জলাশয় এ নিক্ষেপ এর পরিমাণ, বাড়িয়ে চলেছে দূষিত কনা ও বিষাক্ত গ্যাসের বাতাসে নির্গমন। নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথাই শুধু ভেবেছে সে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ পাঠক্রম চালু হয়েছে। তবুও আমরা মাটি জল বাতাস ও নৈসর্গিক পরিবেশকে ক্রমশ অবিশুদ্ধ হতে দেখেছি। দেখেছি আবর্জনা, প্লাস্টিকের স্তুপ, দূষিত ও নোংরা জলে ভারাক্রান্ত নদী, মানুষ আরো দ্রুত, অসীম দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সভ্যতার দিকে। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে নূন্যতম পরিবেশ এর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আসেনি তো সচেতনতা ও সেই অনুযায়ী আচরণ সংশোধন কি করে করবে। আমরা দায়িত্বশীল তথাকথিত সচেতন ব্যক্তিরাও তো পারিনি পরিবেশ বান্ধব আচরণ তৈরি করতে!
মানুষকে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেও আটকানো যায়নি। সেও ভোগবাদে মেতেছে, জীবনযাত্রার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। ফলে বেড়েছে:
মাথাপিছু জল ব্যবহারের পরিমাণ,
মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ,
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের সংখ্যা,
মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধির পরিমাণ,
মাথাপিছু প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ,
নানা বিষাক্ত রাসায়নিকের উৎপাদন ও ব্যবহার,
একই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়।
ফলে আমরা দেখেছি,
অম্ল বৃষ্টি,
হিমবাহের গলন,
আবহাওয়ার চরম ঘটনার বৃদ্ধি,
উদ্ভিদ দেহে ও প্রাণী দেহে প্রভাব বিস্তারকারী নানা রোগের শক্তিবৃদ্ধি,
কোন রোগের প্রাদুর্ভাব তথা মহামারী ইত্যাদি।
বৃক্ষছেদন এর ফলে কোথাও মাটি ক্ষয় হয়ে গিয়ে ভূমি হয়েছে বদ্ধভূমি।
যদি ভৌগলিক বিস্তারের দিক থেকে ধরা যায় তাহলে এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সব থেকে বড় বিপর্যয় হলো কভিদ 19. এই বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র বিভিন্ন দেশ কে যেটা করতে হয়েছে সেটা হল লকডাউন।
আমরা যা দেখলাম লকডাউন পরবর্তী সময়ে:
অর্থাৎ সমগ্র দেশজুড়ে বা দেশের একটি বড় এলাকাজুড়ে সমস্ত মানবীয় কাজকর্ম (human activities) বন্ধ রাখতে হয়েছে বেশ কিছু সময় ধরে- কোথাও একমাস বা কোথাও তিন মাস। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলেনি, শিল্প ও কলকারখানা বন্ধ থেকেছে, বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দোকান বন্ধ থেকেছে (যদিও ভোগ্য পণ্য, কৃষিজ পণ্য এর দোকান খোলা রাখতে হয়েছে জরুরী পরিষেবা হিসাবে, আর খোলা আছে ও মানুষের ভিড় লেগে আছে হাসপাতাল গুলোতে (মানুষের জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব যে তাদের হাতে), কৃষিকাজ ও কম হয়েছে, রাস্তাঘাটে মানুষ কম বেরিয়েছে। কম গাড়ি চেপেছে, কম কিনেছে, নিশ্চয়ই কম্ ভোগ ও করেছে।
তাই কম কীটনাশক, বিষাক্ত রাসায়নিক, পলিথিন প্লাস্টিক নাইলন ইত্যাদিও কম বিক্রি হচ্ছে, আর তাতেই আমরা দেখতে পেলাম কিভাবে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিজেকে সংশোধন করে নিচ্ছে।
দূষিত নদীর জলে পরিচ্ছন্নতার ছবি,
বিষাক্ত হ্রদের জলে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা,
শব্দ দূষণ নেই,
আকাশে বিমানের চিৎকার নেই,
বিমান থেকে নাইট্রোজেন এর নির্গমন বন্ধ,
রাস্তা ঘাটে যানজট নেই,
পলিথিন ও প্লাস্টিক এর স্তুপ যেন ছোট হয়ে এসেছে,
কেমন যেন দুর্গন্ধ গুলো কমে যাচ্ছে,
শহরের বিষাক্ত বাতাসে কেমন যেন হঠাৎ মুক্ত শ্বাসের ইঙ্গিত,
পাশাপাশি থাকা পরিবারের মানুষ গুলোর সম্পর্ক গুলো ও যেন নতুন করে নির্ধারিত হচ্ছে। ঘরে নারীর কাজের অদৃশ্য বোঝা হঠাৎ পুরুষের নজরে এসেছে।
মদ বিক্রি বন্ধ! সব মাদকাসক্ত নেশা মুক্ত হয়ে গেলো কোনও নেশা মুক্তির চিকিৎসা ছাড়া?
নেশায় রাস্তায় পড়ে থাকা দাদা/ কাকা দের তো দেখছিনা আর। কি অদ্ভুত তাইনা? অথচ মাদকাসক্তি ভারতবর্ষের একটি গুরুতর সমস্যা বলেই জানি।
আমরা যা শিখলাম:
আর বিতর্ক নয়, আমরা যে পরিবেশকে নষ্ট করছি সেটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে। এটাও বুঝতে পারছি যে পরিবেশের নিয়ম অনেক সহজ ও সরল, আমরা কেবল অজুহাত খুঁজে ফিরি আর বলি "বড় জটিল এই পৃথিবী!"
সে কিন্তু সোজা-সাপটা জবাব চায় এবং আদায় করে নেয়। তাই প্রকৃতি কে রুষ্ঠ করে আমরা কিন্তু বাঁচতে পারবোনা। এই উপলব্ধি সে আমাদের দিয়ে গেলো। সহজ এই সত্যিটা আমরা কিছুতেই মানতে চায়নি এতদিন। হয়ত এখনও অনেকে বিরুদ্ধ যুক্তি উত্থাপন করবেন কিন্তু এটা সত্যি, যে প্রকৃতি কোনোদিন নিজেকে শেষ করতে দেয়না- তারই সৃষ্টিই হোকনা কেন। সৃষ্টি যদি বিরুদ্ধাচরণ করে, প্রকৃতি নিজেই সেই সৃষ্টি কে সমুলে বিনাশ করে। পৃথিবীতে কিন্তু এর আগেও অনেক প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রজাতি অবলুপ্ত হয়েছে।
আমাদের কে যেটা করতে হবে:
পরিবেশ পাঠক্রম ও দিবস উদযাপনের পাশাপাশি যেটা করতে হবে সেটা হল,
১. এটাই শ্রেষ্ঠ সময়, লকডাউন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক ও পলিথিন কে আমজনতার ব্যবহার থেকে বিদায় জানাতে হবে,
২. ব্যক্তিগত গাড়ি নয় গণপরিবহনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, (যদিও উলটো সুর দেখছি, মোটর সাইকেল ও ব্যাক্তিগত চারচাকা কেনার হিড়িক পড়ে গেছে।)
৩. যেসব শিল্প-কলকারখানা বেশি পরিবেশ দূষণ ছড়াচ্ছিল সেগুলিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করতে হবে।
৪. শিল্প-কলকারখানা গুলো যেন কোনরকম জল মাটি বা বায়ুদূষক পরিবেশের নিক্ষেপ করবে না সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. কংক্রিটের জঙ্গল নয়, হোক নতুন নগর পরিকল্পনা, যেখানে কংক্রিট ও সবুজ সহাবস্থান করবে, মাটি থাকবে মুক্ত ও জল পাওয়ার উপযুক্ত।
৭. ভোগবাদী মূলধনী অর্থনীতির ত্রুটি খুঁজে বের করে "sustainable development" এর পথে হাঁটতে হবে বিশ্ব কে।
একথা ঠিক যে বিশ্ব জুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্র নেতাদের উত্থান ঘটছে। ফলে মার খাচ্ছে প্রকৃতি। কারন এইসব রাষ্ট্র নেতা প্রকৃতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। ক্ষমতার অলিন্দে এরা সব সময় থাকতে চায়। প্রয়োজনে এরা দেশের মানুষ দের ও বিপদে ফেলতে পিছপা হয়না।
তাই সময় এসেছে এখন, মানুষ কেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজের ভালো সবাই বোঝে, তাই নিজের ভালটা বুঝুন। এখানে 'নিজের' কথাটির অর্থটা এখন একটু প্রসারিত করে নিন:
“নিজের বেঁচে থাকার ঘর (প্রকৃতি) কে ঠিক করে রাখুন, যাতে দুর্যোগের দিনে দুশ্চিন্তা বা মৃত্যু ভয়ে দিন কাটাতে না হয়। এটা জীবনের বেঁচে থাকার শর্ত। তাই সেই (ঘরকে) প্রকৃতিকে (habitat) বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে করে আপনার সন্তানরা গৃহহীন না হয়।”
No comments:
Post a Comment