Introduction:
পৃথিবীর সমস্ত দেশ বা দেশের সমস্ত স্থান প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক দিক থেকে এক রকম উন্নত হয় না। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে বা দেশের মধ্যে একটা অসাম্য অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য কতগুলো উপাদান দায়ী, এগুলি হল-
Physical factors: বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ, জলবায়ু, মৃত্তিকা, আপেক্ষিক অবস্থান, উচ্চতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিষয় গুলি বিভিন্ন স্থানের মধ্যে অসাম্যের সৃষ্টি করে। যদি কোন অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ বেশি থাকে, জলবায়ু অনুকূল হয় তাহলে সেই অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত হবে এটা বলা যায়। অন্যদিকে যে সমস্ত স্থানগুলিতে উপরোক্ত উপাদানগুলো প্রতিকূল থাকে সেই সমস্ত স্থান সহজে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারে না।
Cultural factors: অপ্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক সমূহ যেগুলি কোন স্থানের উন্নয়ন বা উন্নয়নের পেছনে দায়ী বলে মনে করা হয় সেগুলি হল, জনসংখ্যার পরিমাণ, জনসংখ্যার গুণগত দিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির স্তর, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতির স্তর ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো অনুকূল হলে সাধারণত কোন স্থান অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব দ্রুত উন্নত হয়। অন্যদিকে যে সমস্ত স্থানগুলিতে উপরোক্ত উপাদানগুলো প্রতিকূল থাকে সেই সমস্ত স্থান সহজে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারে না।
এই সমস্ত প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক তথা মানবীয় দিকগুলির বিভিন্নতা বা পার্থক্য থাকা সত্বেও কোন একটি অঞ্চলে দীর্ঘকালীন সময়ে কিভাবে ভারসাম্যমূলক অর্থনৈতিক উন্নতি হতে (balanced regional development with integrated space economy) পারে সে বিষয়ে মতবাদ প্রকাশ করেন John Friedman তার core periphery model এর মাধ্যমে। আমেরিকার অর্থনীতিবীদ John Friedman 1966 সালে তার "regional development policy: a case study of Venezuela" নামক গ্রন্থে core periphery model টি প্রকাশ করেন এবং তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে কিভাবে একটা অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে core এবং periphery অঞ্চল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থেকে সমগ্র অঞ্চলের ভারসাম্যমূলক উন্নতি ঘটায়।
এবার প্রথমে আমরা দেখে নিই যে তিনি core এবং periphery বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছিলেন।
Core: কোর বলতে তিনি সেই এলাকাকে বুঝিয়েছেন যে এলাকা অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতা সম্পন্ন হয়। এই সমস্ত এলাকা প্রযুক্তি বিদ্যায় উন্নত হয় নতুন নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি গৃহীত হয় এবং যেহেতু অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতা সম্পন্ন হয় তাই প্রচুর পরিমাণে মূলধনের জোগান ও বিনিয়োগ এখানে হয়ে থাকে।
সাধারণত যে সমস্ত এলাকাতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক গুলি অনুকূল থাকে সেই সমস্ত এলাকা গুলি কোন একটি অঞ্চলে অর্থনৈতিক কেন্দ্রীয় এলাকা হিসেবে উঠে আসে।
Periphery: পেরিফেরি বলতে সাধারণত পরিধি অঞ্চলকে বোঝায়। অর্থাৎ কোর অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকা যেখানে অর্থনীতি দুর্বল, উদ্ভাবন নেই এবং প্রযুক্তিবিদ্যা অভাব রয়েছে কিন্তু শ্রমিকের পরিমাণ বেশি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক বেশি থাকে, সেই এলাকাকেই উনি পেরিফেরি বলে বুঝিয়েছেন। সাধারণত এই পেরিফেরি এলাকা থেকে শ্রমিক উচ্চ মজুরির আশায় কোন এলাকাতে চলে যায় যার ফলে পেরিফেরি থেকে কোর এলাকার মধ্যে শ্রমিকের পরিব্রাজন ঘটে।
কোন এলাকা প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত এবং আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব থাকায় এবং শ্রমিক এর অভাব থাকায় পেরিফেরি এলাকা থেকে শ্রমিক এবং কাঁচামাল সংগ্রহ করে এবং এর মধ্য দিয়েই কর অঞ্চল উন্নত হয় অর্থনৈতিক দিক থেকে। তাই কোন অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোর এবং পেরিফেরি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে।
মূল বিষয়বস্তু:
ফ্রিডম্যানের কোর পেরিফেরি মডেলের মূল বিষয়বস্তু গুলি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
I) কোন কেন্দ্রের নগর এলাকার দ্রুত উন্নতি লাভ করে যেখানে অন্যান্য সমস্ত পার্শ্ববর্তী এলাকা নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত হয় এবং দারিদ্রতায় ভোগে- এর ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে আমরা পাই।
II) এই তত্ত্বে চারটি পর্যায়ের মাধ্যমে কোন একটি অঞ্চলের উন্নয়ন প্রণালীর কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
III) প্রথম অবস্থা থেকেই অর্থনৈতিক বৈষম্য এই কোর এবং পেরিফেরি এলাকার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রক সমূহ মূল ভূমিকা পালন করে।
IV) কিভাবে কোর এবং পেরিফেরি অসাম্য দূর করে সমগ্র এলাকার ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন ঘটায় তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এই তত্ত্বে।
বিভিন্ন এলাকা সমূহ:
ট্রিটমেন্ট ফ্রিডম্যান তার কোর-পেরিফেরি মডেলের ব্যাখ্যায় একাধিক এলাকার কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থেকে ধাপে ধাপে সমগ্র এলাকার ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন ঘটায়। এগুলি হল-
1.কেন্দ্রীয় এলাকা বা CORE
2.ঊর্ধ্বগামী পরিবর্তনশীল এলাকা বা Upward transition region
3.সম্পদ সীমান্ত এলাকা বা Resource frontier region
4.নিম্নগামী পরিবর্তনশীল এলাকা বা downward transition region
Core: কোর এলাকা বলতে তিনি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত এলাকার কথা বলেছেন।
Upward transition region: এই এলাকাটি কেন্দ্রীয় এলাকার একেবারে পার্শ্ববর্তী এলাকা কে বোঝায় জেটি কেন্দ্রীয় এলাকাকে কাঁচামালের যোগান দেয়। যেহেতু কোর এলাকার পাশেই এই এলাকায় অবস্থিত তাই এই এলাকাটি উন্নয়ন দ্রুত হয় সেজন্যই এ কে Upward transition region বলা হয়েছে।
Resource frontier region: এই অঞ্চল কোর বা কেন্দ্রীয় এলাকাকে সম্পদের যোগান দেয়। কৃষিভিত্তিক এই এলাকাটি বিভিন্ন শস্য উৎপাদন করে এবং কেন্দ্রীয় এলাকাতে তা সরবরাহ করে এবং এর বিনিময়ে এই এলাকা কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে অর্থ উপার্জন করে। যেহেতু এই এলাকাটি সম্পদ সমৃদ্ধ হয় তাই আর্থিক মুনাফা লাভের আশায় এখানে কিছু কিছু বিনিয়োগ ভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়। তাই এই এলাকাকে newly colonised region বলা হয়ে থাকে।
downward transition region: এই অঞ্চলটি অর্থনৈতিক দিক থেকে সব থেকে পিছিয়ে পড়া হয় তার কারণ হিসেবে এখানকার সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা দায়ী। একেবারে প্রাচীন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ হয়ে থাকে এখানে। তবে বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে পড়া হলেও এই এলাকাতে প্রচুর শ্রমিক সহজলভ্য থাকে তাই এই অঞ্চল মূলত কেন্দ্রীয় এলাকাতে শ্রমিক সরবরাহ করে।
উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায় সমূহ : (Stages of development)
ফ্রিডম্যান তার তত্ত্বে চারটি ধারাবাহিক উন্নয়ন পর্যায়ের কথা বলেছেন। এগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল।1.Pre-industrial stage: এই পর্যায়ে সাধারণত কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার লক্ষ্য করা যায়। সমস্ত দেশ বা অঞ্চলের উন্নয়ন মোটামুটি একই অবস্থায় থাকে এবং বিভিন্ন এলাকার মধ্যে বিশেষ বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় না। শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে যে জনবসতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে দেখা যেত সেখানে এই ধরনের অবস্থা লক্ষ্য করা যেত। বর্তমানে এই পর্যায়ে বিশেষ কোথাও দেখা যায় না আফ্রিকার কিছু এলাকা বাদ দিলে।
2.Transitional economy stage: এই পর্যায়ে যে সমস্ত এলাকাতে প্রাকৃতিক সুবিধা বর্তমান থাকে এবং যে সমস্ত এলাকাতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রক গুলি অনুকূল থাকে সেই সমস্ত এলাকা দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয় এবং উন্নত কৃষির পাশাপাশি শিল্প ভিত্তিক উন্নয়ন এই সমস্ত এলাকাতে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে যে সমস্ত এলাকাতে ধাতব খনিজ যেমন আকরিক লোহা এবং পাশাপাশি জ্বালানি খনিজ যেমন কয়লা পাওয়া যায় সেই সমস্ত এলাকাতে যদি প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে থাকে তাহলে সেখানে লৌহ ইস্পাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প গড়ে ওঠার মাধ্যমে দ্রুত অগ্রগতি ঘটবে। এই সমস্ত দ্রুত উন্নতি প্রাপ্ত এলাকা গুলি কেন্দ্রীয় এলাকা বা কোর হিসাবে উঠে আসবে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও কৃষি নির্ভর হয়ে থাকবে যেগুলি প্রান্তীয় এলাকা বা পেরিফেরী হিসেবে অবস্থান করবে। এই সময়ে বিভিন্ন এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেশি থাকে।
3.Industrial economy stage: যত দিন যেতে থাকে ততো মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকে। ক্রমবর্ধমান আয় কিছু মানুষের হাতে আসে যার ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে কেন্দ্রীয় এলাকা ও তার আশেপাশে র এলাকায়। বহু মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা একটিমাত্র কেন্দ্রীয় এলাকার পক্ষে মেটানো সম্ভব হয় না। তার ফলে অবস্থানগত সুবিধা নিয়ে কেন্দ্রীয় এলাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে একাধিক উপ-কেন্দ্রীয় এলাকা (sub centre) গড়ে ওঠে যেগুলো মানুষের ক্রমবর্দ্ধমান চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান দেয়। এইভাবে কেন্দ্রীয় এলাকা এবং উপকেন্দ্র এলাকার বৃদ্ধির ফলে তাদের অন্তর্বর্তী প্রান্তীয় এলাকা একই রকম ভাবে থেকে যায় বা সংকীর্ণ হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় এলাকা উপ কেন্দ্রীয় এলাকা এবং প্রান্তীয় এলাকার মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি পায়। এই সময় মূল কেন্দ্রীয় এলাকায় এবং উপকেন্দ্র এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ কমতে থাকলেও এই সমস্ত কেন্দ্রীয় এলাকার সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী প্রান্তীয় এলাকার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য তখনও অনেক বেশি থাকে।
4.Post industrial economy stage: ফ্রিডম্যান প্রদত্ত চারটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্তরের সর্বশেষ পর্যায়ে টি হল শিল্প পরবর্তী অর্থনৈতিক পর্যায়। এই পর্যায়ে কেন্দ্রীয় এলাকা এবং উপকেন্দ্র এলাকার মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে যেমন জিনিসপত্রের আদান-প্রদান অনেক বেশি হয় তেমনি এই সমস্ত কেন্দ্রীয় এলাকার সঙ্গে তাদের পার্শ্ববর্তী তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া প্রান্তীয় এলাকার সঙ্গেও পারস্পরিক আদান-প্রদান সংঘটিত হয়। ফলে সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক সংযোগ (functional integration) গড়ে ওঠে। যার ফলে কেন্দ্রীয় এলাকা এবং প্রান্তীয় এলাকা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় প্রসার প্রভাব (spread effect or trickle down effect) কার্যকর হয় এবং প্রান্তীয় এলাকাগুলি ও ধীরে ধীরে উন্নত হতে শুরু করে যার ফলে সমগ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমতে থাকে।
মূল্যায়ন:
No comments:
Post a Comment